এশিয়া খবর ডেস্ক:: কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ালে দেশের শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা করেছেন
তৈরি পোশাক খাতের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ’র নেতারা।
তাদের মতে, এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির চাপ শিল্প সইতে পারবে না। এমনিতে নানা প্রতিকূলতায় একের পর এক শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই অন্তত দুই বছর পর যৌক্তিকভাবে পর্যায়ক্রমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত। তবে তার আগে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ, সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা ও গ্যাসের ইবিসি মিটার সরবরাহ করতে হবে। যাতে ব্যবসায়ীরা বিগত দিনের লোকসানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।
বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি পোশাক খাতের ৩ সংগঠনের নেতারা এ আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
এতে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ও বিকেএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মনসুর আহমেদ নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তৈরি পোশাক খাত মোট গ্যাসের ৭-৮ শতাংশ ব্যবহার করে। আর পুরো শিল্প খাতে ১৬-১৭ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হয়। ২০১২ থেকে গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি। সবেমাত্র কিছু কারখানায় কানেকশন দেয়া হচ্ছে। মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বছরের পর বছর গ্যাস সংযোগের জন্য ঘুরছেন। এখন মাত্র সংযোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে নতুন করে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। অন্তত ২ বছর পর গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, একতরফভাবে গণশুনানি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। শুনানিতে ব্যবসায়ীরা যা-ই বলেন না, সেটা আমলে নেয়া হয় না। একতরফাভাবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ব্যবসায়ীরা চান না। জ্বালানি নীতি প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি নীতি দেয়া না হলে ব্যবসায়ীরা কিসের ভিত্তিতে শিল্প করবে। প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে। শুধু একতরফাভাবে কোনো জায়গায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না।
আক্ষেপ করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শূন্য থেকে এই শিল্পকে দাঁড় করানো হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিক‚লতার কারণে শুধু বিজেএমইএ’র ৬ হাজার সদস্যের মধ্যে ৩ হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, উদ্যোক্তা প্রতিদিন জন্মায় না। একটা উদ্যোক্তা জন্মাতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু তার গলাটিপে হত্যা করা উচিত না। যুগে যুগে তা-ই করে আসা হচ্ছে। বিগত সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকের উচ্চ সুদের কারণে উদ্যোক্তাদের গলাটিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। এখন ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর রক্ত দিতে রাজি না। যে কোনো কিছু করতে হলে আলাপ-আলোচনা করে করতে হবে।
যৌক্তিকভাবে পর্যায়ক্রমে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তা মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করে বলেন, তার আগে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ, সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা ও গ্যাসের ইবিসি মিটার সরবরাহ করতে হবে। এরপর যৌক্তিকভাবে পর্যায়ক্রমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে আমরা সে অনুযায়ী দিতে রাজি আছি। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হবে। আর এফডিআরের সুদহার ৬ শতাংশ হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ব্যাংক সেটি বাস্তবায়ন করেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, শিল্পের একমাত্র কাঁচামাল সস্তা শ্রম ও ক্যাপটিভ পাওয়ার। এর ওপর ভিত্তি করে শিল্পের বিকাশ হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে শ্রমের খরচ প্রায় ১০০ গুণ বেড়েছে। এখন ক্যাপটিভ পাওয়ারে খরচ বেড়ে গেলে অন্য দেশের তুলনায় অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে। এছাড়া সরকার বারবার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংকঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। ডাবল ডিজিটে ব্যাংকঋণ নিতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক ব্যবসায়ীকে ডিমান্ড নোট দেয়া হয়েছে; কিন্তু সংযোগ এখনও পায়নি। ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে ১০ বছরের জ্বালানির দাম বৃদ্ধির রূপরেখা দিতে হবে। সে রূপরেখা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করবে। কিন্তু এক সকালে ঘুম থেকে ওঠে ১৩২ শতাংশ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির খবর শুনতে চাই না।
এর আগে লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিইআরসির গণশুনানিতে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা ৪ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রস্তাব অনুযায়ী শিল্পের গ্যাসের মূল্য ১৩২ শতাংশ বাড়বে। এতে পোশাকের উৎপাদন খরচ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এ প্রস্তাব শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। মূল্যবৃদ্ধি বস্ত্র ও পোশাক খাতের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তিনি আরও বলেন, বস্ত্র খাতে কাঁচামালের পরই গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উদ্যোক্তারা একসময় সরকারের পরামর্শেই বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশন শুরু করেন। সে সময় উচ্চ সুদে ব্যাংকঋণ নিয়ে জেনারেটর আমদানিসহ বিপুল বিনিয়োগ করেছেন। এখন নতুন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে দেশের বস্ত্র মিলগুলোর পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে।
বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিল্পে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ পাচ্ছি না। গ্যাস পেলেও আবার অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত সরবরাহ পাচ্ছি। আবার যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করছি, তার চেয়েও বেশি বিল পরিশোধ করছি। অর্থাৎ গ্যাস ব্যবহার না করেও তিতাস গ্যাস কোম্পানিকে বাতাসের মূল্য দিচ্ছি। দীর্ঘদিন ধরে ইভিসি মিটার চেয়ে আসছি, যাতে প্রেসার অনুযায়ী গ্যাসের দাম দিতে পারি। ২-৩ বছরেও গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ইভিসি মিটার দিতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কী? যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ক্রমেই কমছে। সারা বিশ্বে কোথাও এভাবে জ্বালানির দাম বাড়ানোর নজির নেই।
জ্বালানি নীতি প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাতে গ্যাসের বিকল্প নেই। কিছুদিন পর পর গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাই শিল্পকে সহায়তা করতে শিগগিরই জ্বালানি নীতি প্রণয়ন এবং সেই নীতিতে রফতানিমুখী শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। শুধু একটি সেক্টরের অধিক মুনাফার কথা বিবেচনা না করে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীল খাতগুলোর স্বার্থ বিবেচনায় নেয়া উচিত। পোশাক ও বস্ত্র খাত টিকিয়ে রাখতে গ্যাসের বর্ধিত মূল্য থেকে অব্যাহতি দেয়ার দাবি জানান তিনি।
লিখিত বক্তব্যে টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, প্রাইমারি টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাত ধ্বংস করার জন্য একটি বিশেষ মহল নিয়োজিত আছে। টেক্সটাইল খাতের ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখে তাদের পূর্বপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত এক বছরে টেক্সটাইল খাতের বিভিন্ন আকারের প্রায় ৩০০টি মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
১০ বছরে ছয়বার গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য ৪০০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে অতিরিক্ত ৮ টাকা ৫ পয়সা বা ৯ সেন্ট খরচ হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি সুতা ৩০ সেন্ট লোকসান হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে প্রতি কেজি সুতায় অতিরিক্ত খরচ বাড়বে ৭ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে বিদ্যমান লোকসানের সঙ্গে গ্যাসের ট্যারিফ যোগ করলে প্রতি কেজি সুতায় শুধু বিদ্যুৎ খরচে অতিরিক্ত ৩২ টাকা ৯২ পয়সা যোগ হবে। খরচ বেড়ে গেলে দেশের সুতা আর কেউ কিনতে চাইবে না। ফলে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। প্রাইমারি টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। পোশাক খাতের মোট রফতানির বিপরীতে প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতের অবদান ১৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। ফলে এ খাতটি যদি বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে রিজার্ভ সংকুচিত করবে। তাছাড়া নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রথম আঘাত আসবে ব্যাংকিং খাতের ওপর।
তিনি আরও বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হলে বিদ্যমান শিল্পকারখানাগুলো প্রতিযোগিতামূলত থাকতে পারবে কি না, সে বিষয়ে গবেষণা না করেই গ্যাস কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী মূল্যবৃদ্ধি হবে আÍঘাতী। কোনো কারণ ছাড়াই বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
বিকেএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মনসুর আহমেদ বলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু লোকজন আছে যারা ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে না। শিল্পের গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে গর্বের সেক্টর ধ্বংস হতে বেশি দিন সময় লাগবে না। তিতাসসহ অন্য সব ইউটিলিটি সেবা খাতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রতিনিধি রাখার সুপারিশ করেন তিনি।