পঞ্চগড় থেকে মোঃ কামরুল ইসলাম কামু : উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে বিষমুক্ত সবজির চাষ শুরু হয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত সবজি চাষে এখানকার চাষিরা ব্যবহার করছেন জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক। এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে বেশ সাড়া পেয়েছেন তারা।
এতে কম খরচে তারা যেমন উতপাদিত সবজির ভালো দাম পাচ্ছেন, তেমনি ক্রেতারাও পাচ্ছেন বিষমুক্ত সবজির স্বাদ। চারদিকে যখন ফসল উতপাদনে রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের ছড়াছড়ি, তখন আশার আলো জুগিয়েছে পঞ্চগড়ের কয়েকটি গ্রামে বিষমুক্ত সবজি চাষ। সদর উপজেলার কামাতকাজলদীঘি ইউনিয়নের ঘটবর, পঞ্চগড় ইউনিয়নের ভাবরঙ্গী ও শিংপাড়া, হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের পাইকানী এবং হাফিজাবাদ ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামে কৃষকরা বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন। এতে তারা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। গ্রামগুলোতে গেলেই দেখা মিলবে- ক্ষেতে ঝুলছে নানা ধরনের জৈব বালাইনাশক। মিষ্টি কুমড়া, লাউ, শসা, পটল, পেঁয়াজ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটোসহ নানা শাক-সবজির ক্ষেতে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা এসব জৈব বালাইনাশক শোভা পাচ্ছে। সবজির জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমন করতে সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ, কালার ট্র্যাপ ও আকর্ষণ ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও কাকতারুয়াও বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। আগে পোকা দমনে কেবল সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ ও আকর্ষণ ফাঁদ ব্যবহার করা হলেও নতুন করে যুক্ত হয়েছে কালার ট্র্যাপ। পুরনো প্লাস্টিকের জার হলুদ রং করে তাতে মবিল মেখে ক্ষেতের মধ্যে খানিক উঁচুতে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে জাব পোকা, সাদা মাছি, থ্রিপিসসহ শোষক পোকা হলুদ রঙে আকৃষ্ট হয়ে মবিলে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। মাত্র ১৫ থেকে ২০ টাকা খরচে এ জৈব বালাইনাশক তৈরি করা যায়। জৈব বালাইনাশক প্রয়োগে কীটনাশক ছাড়াই খুব অল্প খরচে পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করছেন চাষিরা। কৃষি কর্মকর্তারাও চাষিদের বিষমুক্ত সবজি চাষে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে শাক-সবজি চাষে উতপাদন খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে। সেইসাথে বাজারে বিষমুক্ত সবজির ব্যাপক চাহিদা থাকায় দামও ভালো পাচ্ছেন চাষিরা। শাক-সবজি বিক্রি নিয়ে কোনো বিড়ম্বনাও পোহাতে হয় না চাষিদের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নির্ধারিত বিষমুক্ত সবজির দোকানের মাধ্যমে এসব সবজি বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে রাসায়নিকে উতপাদিত সবজির তুলনায় বিষমুক্ত সবজি বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। এতে চাষিরা যেমন খুশি, তেমনি ক্রেতারাও পাচ্ছেন বিষমুক্ত সবজির সেই আদি স্বাদ। পঞ্চগড়ের ঘটবর এলাকার চাষি রাজু আহম্মেদ বলেন, আমরা আমাদের গ্রামে একটি কৃষক সমবায় সমিতি করেছি। এ সমিতির প্রত্যেক সদস্যই বিষমুক্ত সবজি চাষাবাদ করছে। বাজারে আমাদের সবজির চাহিদা বেশি। তাই বিক্রি করতে কোন সমস্যা হয় না। পাশাপাশি দামও ভালো পাওয়া যায়। একই গ্রামের কৃষক ফজলুল হক বলেন, বিষমুক্ত সবজি চাষ করতে আমরা মূলত জৈব সার ও বিভিন্ন জৈব বালাইনাশক- যেমন ফেরোমন ট্র্যাপ, আকর্ষণ ট্র্যাপ ও কালার ট্র্যাপ ব্যবহার করছি। এসব ব্যবহার করেই পোকা দমন করা যাচ্ছে। তাই কীটনাশকের প্রয়োজন পড়ছে না। বাজারে এখন সার ও কীটনাশকের দাম অনেক। এ পদ্ধতিতে আমাদের উতপাদন খরচ অনেক কমে আসছে। সেইসাথে বিষমুক্ত সবজি চাষ করে আমরা নিজেরাও খেতে পারছি, ক্রেতারাও নিরাপদ সবজি পাচ্ছেন। এটাই আমাদের কৃষকদের আনন্দের বিষয়। পঞ্চগড় সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহ আলম মিয়া বলেন, শাক-সবজি ও ফসলের জন্য ক্ষতিকারক যেসব শোষক পোকা রয়েছে, সেসব থেকে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেই রক্ষা পাওয়া যায়। এক-একটি বালাইনাশক তৈরি করতে খরচ হয় মাত্র ১৫ থেকে ২০ টাকা। আগে সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ ও আকর্ষণ ট্র্যাপ ব্যবহার করেছেন চাষিরা। হলদে কালার ট্র্যাপটির আইডিয়া আমার। এখন কৃষকরা এ কালার ট্র্যাপ ব্যবহার করে পোকার হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে পারছেন। দিনদিন এ পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি চাষের পরিমাণ বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আবু হোসেন বলেন, নিরাপদ সবজি চাষের জন্য আমরা চাষিদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। নিরাপদ সবজি উতপাদন করতে তারা যেসব উপকরণ ব্যবহার করছে, তাতে খরচ অনেক কমে আসছে। এছাড়া, বাজারে আমাদের নির্ধারিত সবজির দোকানে নিজেদের উতপাদিত সবজি বিক্রি করতে পারছে তারা। সেখান থেকে ক্রেতারা বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি কিনতে পারছে। আশা করি, সামনে বিষমুক্ত সবজি চাষের পরিধি আরো বাড়বে।