এশিয়া খবর ডেস্ক:: ঢাকা ব্যাংকের পরিচালক এমএনএইচ বুলু ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর রোড শাখার একজন ঋণখেলাপি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক শাহেদুল হক খেলাপি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখার। আইন অনুযায়ী, ঋণখেলাপি কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারেন না। তবে তথ্য গোপন করে এ দু'জনই পরিচালক পদে বহাল আছেন। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) থেকে ঋণখেলাপি পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিষয়টি ধরা পড়ার পর প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিআরপিডি। শুধু এ দু'জন নন, ঋণখেলাপি আরও অনেকের ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল থাকার ঘটনা রয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া ছাড়াও কোনো কোনো পরিচালকের বেনামি ঋণ থাকার তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। যোগসাজশের মাধ্যমে একে অন্যের ব্যাংক থেকে তুলনামূলক কম সুদে এবং সক্ষমতার তুলনায় বেশি ঋণ নেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। ব্যাংকের এমডি বা কর্মকর্তারা বিষয়টি জানলেও ঋণ আদায়ে অনেক ক্ষেত্রে ভয় পান। ফলে এসব ঋণের একটি অংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকদের নামে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫২৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকা এসএ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন আলমকে গ্রেফতারের পর ঋণখেলাপি হয়েও পরিচালক পদে থাকার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত ১৭ অক্টোবর গুলশানের একটি কফি হাউস থেকে শাহাবুদ্দিনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির ৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকার ঋণের বেশিরভাগই এখন খেলাপি। শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা, জালিয়াতি ও ঋণখেলাপি-সংক্রান্ত ১২০টি মামলা রয়েছে। কয়েক মাস আগে জাতীয় সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায়ও তার নাম ছিল। এ রকম আরও অনেকে খেলাপি হয়েও ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল আছেন।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারেন না। তবে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে অনেকেই পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন। আবার অনেক পরিচালক আদালতের নির্দেশে খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পাচ্ছেন। তবে ইউসিবিএলের মিরপুর শাখায় এমএনএইচ বুলুর ৫৮ কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখায় শাহেদুল হকের ৬১ কোটি ৫ লাখ টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য এসবের বাইরে ছিল। সংশ্নিষ্ট ব্যাংক এ তথ্য গোপন করে তাদের পরিচালক থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। যদিও ইউসিবিএলের মিরপুর রোড ছাড়াও প্রিন্সিপাল, গুলশান, বসুন্ধরা, তেজগাঁও, পান্থপথ ও বনানী শাখায় বুলুর মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৩৫০ কোটি টাকার ঋণখেলাপি রয়েছে। তবে এসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেওয়া থাকলেও মিরপুর রোড শাখার ক্ষেত্রে তা ছিল না। এমএনএইচ বুলু বিএনএস গ্রুপের কর্ণধার। ১০৯ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং প্রায় ২৫ কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ৭ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
সূত্র জানায়, বুলু ও শাহেদুল হকের বিষয়ে গত ২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ থেকে বিআরপিডিতে একটি চিঠি দেওয়া হয়। বিআরপিডির মহাব্যবস্থাপক বরাবর লেখা চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ওই দুই ব্যক্তি ঋণখেলাপি হওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বুলুর তথ্য গোপনের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের ২০১৭ সালের ডিসেম্বর-ভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে ধরা পড়ে। আর শাহেদুল হকের খেলাপির তথ্য উঠে এসেছে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর-ভিত্তিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখন ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের বক্তব্য চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এমএনএইচ বুলু সমকালকে বলেন, নানান ঝামেলার কারণে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। এজন্য কয়েক মাস ঢাকা ব্যাংকের পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে। ২০১৭ সালে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর রোড শাখার ঘটনা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, তখন পরিচালক ছিলাম। তবে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। যদিও ঢাকা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এখনও পরিচালক হিসেবে এমএনএইচ বুলুর নাম রয়েছে।
ঋণখেলাপির দায়ে সম্প্রতি নতুন প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের দুই পরিচালককে অনাপত্তি দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদের মধ্যে এগ্রোভিটা গ্রুপের কর্ণধার এম মোয়াজ্জেম হোসেন সম্প্রতি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালক পদে বহাল হয়েছেন। আর রতনপুর গ্রুপের কর্ণধার মাকসুদুর রহমান পরিচালক পদ ফিরে পেতে নানা উপায়ে চেষ্টা করছেন। মাকসুদুর রহমান সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া শাহাবুদ্দিন আলমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সাউথ বাংলা ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকার বেনামি ঋণ নিয়ে আর ফেরত না দেওয়ায় পরিচালক পদ হারিয়েছেন তিনি। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকে তার বিপুল অঙ্কের ঋণ রয়েছে। ২০১৫ সালে তিন ব্যাংকে তিনি ৮১২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেন। এসব ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। এ ছাড়া ব্যাংকটির আরেক পরিচালক সান মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালক পদে বহাল আছেন। এ রকম আরও অনেক পরিচালক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে বহাল আছেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সংশ্নিষ্ট ব্যাংক থেকে এসব ক্ষেত্রে পাল্টা আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, যে কোনো শাখায় ঋণখেলাপি হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ দু'জনের ক্ষেত্রে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সংশ্নিষ্ট বিভাগের জবাব পাওয়ার পর বোঝা যাবে। তিনি আরও বলেন, ঋণখেলাপিরা বড় আইনজীবীর মাধ্যমে পদক্ষেপ নেন। আরেকজন আইনজীবীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়াটা অনেক ব্যয়বহুল। যে কারণে স্থগিতাদেশের পর সবসময় আদালতে যাওয়া সম্ভব হয় না।
জানতে চাইলে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান ও বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সমকালকে বলেন, ঋণখেলাপি হলে আইন অনুযায়ী এমনিতেই পরিচালক পদ চলে যায়। এখন খেলাপি হয়েও কেউ যদি আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেন, এক্ষেত্রে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা ছাড়া ব্যাংকের কিছু করার থাকে না।