
ডেস্ক রিপোর্ট : : বছর ছয়েক আগে, পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির আয়োজিত ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখা।
কথা বলে জানা গেল, ছিমছাম সাদামাঠা ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়াশুনা করছেন। তবে সংস্কৃতিতে কেবল পড়াশুনা না, দেশিয় সংস্কৃতিকে ভালবেসে কিছু করার প্রবল ইচ্ছে তখন। শিল্পের ভাষায় সাধারণ মানুষকে কিছু শিক্ষা দিনে চান, বলতে চান সমাজের চারপাশে ঘটে যাওয়া গল্প। তিনি মীর লোকমান, একজন পুরাদস্তুর মূকাভিনয়শিল্পী।
হ্যাঁ, সেটি করতে এখন লোকমান সক্ষম। শুধু সক্ষম বললে ভুল হবে, তা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। থেমে থাকতে রাজি নন এই শিল্পচর্চার তরুণ। লোকমানের জন্ম নরসিংদীর শিবপুরে। ছোটবেলা থেকেই ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থেকেই আজকের মূকাভিনেতা লোকমান। সবশেষ ইউরোপের আর্মেনিয়ায় পারফর্ম করে এসেছেন। জানালেন তার সফলতার গল্প, আগামীর পথচলা নিয়ে ভাবনার কথা।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ২০০৩ সালে নরসিংদীতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মূকাভিনয় বা মাইমের শো দেখার পর মূকাভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মে। এরপর নিজে নিজেই মূকাভিনয় চর্চা শুরু করেন। ২০০৯ সালে শাহজালাল বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মূকাভিনয়ের শো দেখেন এবং তাঁর মনে মূকাভিনয়টা গেঁথে যায়। মাইমই হবে তাঁর প্রফেশন, যেই কথা সেই কাজ।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিল্পকলা একাডেমিতে ১৫ দিনব্যাপী মাইমের ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষণ নেন লোকমান। তাঁর প্রশিক্ষক কাজী মশহুরুল হুদার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরে মূল অনুষ্ঠানে জাতীয় নাট্যশালায় পরিবেশনা করেন। দর্শকরা অভিনয়ের প্রশংসা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে লোকমান খোঁজ নিয়ে দেখেন বাংলাদেশে মূকাভিনয়ের কাজ তেমনভাবে শুরু হয়নি, তেমন বিকাশ লাভ করেনি। বাংলাদেশের যত ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্জন সব কিছুর পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। ঢাবি থেকেই সারা দেশে মূকাভিনয়কে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাবিতে মূকাভিনয়কে জনপ্রিয় করতে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ‘না বলা কথাগুলো না বলেই হোক বলা’ স্লোগানে টিএসসির চত্বরে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশন।
লোকমান বলেন, পুরো বাংলাদেশে মূকাভিনয়কে জনপ্রিয় করা, মূকাভিনয় শিল্পের, সমাজের, মানুষের প্রতি দায়ের জায়গা থেকে অন্যায়ের বিপরীতে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে এবং তিনি আশা করেন একদিন মূকাভিনয় আমাদের দেশে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়ে ভারত ও আর্মেনিয়াতে মাইমকে উপস্থাপন করেন। ২০১৬ সালে ভারতে মূকাভিনয়ে দলগতভাবে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে মাইমে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৬ সালে ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে ওয়েস্টার্ন ড্যান্সে প্রথম রানার আপ হন। তার ‘সর্বরোগের মহাচিকিৎসক’ শিরোনামের মূকাভিনয় প্রযোজনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মূকাভিনয় দল চ্যাম্পিয়ন হয়।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে মাইম ফেস্টিভালে অংশ নেন লোকমান এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। এ ছাড়া তিনি অসংখ্য জায়গায় মাইমের অনুষ্ঠান করেন। মীর লোকমান ৩৫০টির বেশি মাইম পরিবেশন করেছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিল, শিল্পকলা একাডেমি, জার্মান কালচারাল সেন্টার, চায়না বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রথম আলো জাতীয় বন্ধুসভা উৎসব, আন্তর্জাতিক ইয়ুথ ফেস্টিভাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করেন তিনি। এ ছাড়া নিয়মিত প্রদর্শনী, জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে পারফর্ম করেন তিনি।
লোকমান বিভিন্ন সময়ে লরেন ডিকল, কাজী মশহুরুল হুদা, পার্থ প্রতীম মজুমদার, রণেন চক্রবর্তী, পদ্মশ্রী নিরঞ্জন গোস্বামীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে মূকাভিনয় শিখেছেন। তিনি নাটকসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিনয় করেন। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার একটি মিউজিক ভিডিওতে কাজ করেন। ক্যাম্পাস ক্লাইমেক্স ছবিতে অভিনয় করেন এবং বিভিন্ন চ্যানেলে মূকাভিনয় অনুষ্ঠান করেন। এ ছাড়া টিভি ফিকশন ১৮+, শর্টফিল্ম ক্রাউন, রেড কার্পেট, অবশিষ্ট বুলেট, লাল রঙের গল্পতে অভিনয় করেন। প্রতিবছর এপ্রিল মাসে মাইম অ্যাকশনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাইমের আয়োজন করেন, যেখানে জাপান, ভারত, নেপাল, ভুটান অংশগ্রহণ করে। ২০১০ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘জীবনের প্রতিধ্বনি’।
আগামী জানুয়ারিতে মাইমের প্রতিযোগিতায় বেলজিয়াম বা ইংল্যান্ডে যাওয়ার কথা রয়েছে বলে জানালেন লোকমান। ইংল্যান্ড ঘুরে আসার পর হয়তো লোকমানের সফলতার খাঁতা আরো ভারি হবে, প্রত্যাশাটা করাই যায়। ‘ভালকিছু করতে চাই, নিজের জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব আমি তা করে যাবো।’ বলছিলেন এই সফল মূকাভিনয়শিল্পী।
ইত্তেফাক