
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিঃ: নিজেকে কখনও পরিচয় দেন গোয়েন্দা পুলিশের ওসি,
কখনও দারোগা আবার কখনও র্যাবের অফিসার। যাতায়াত করেন বিমানে। তার প্রধান টার্গেট চোরাই তেল ব্যবসায়ীদের গুদামে হানা দিয়ে লাখ লাখ টাকার তেল হাতিয়ে নেয়া অথবা বড় ইয়াবার চালান আটক করে সেগুলোকে রপ্ত করা। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, জাল টাকা ও নারী ব্যবসায়ী এই সোর্সয়ের খপ্পরে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। জরিমানা গুনতে হয়েছে লাখ লাখ টাকা। যেকারণে সোর্স আনোয়ার আতঙ্কে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করতে গিয়ে গ্রেফতারও হয়েছেন কয়েকবার। রয়েছে খুনের মামলা সহ ১২ টি মামলা। সেই ভুয়া পুলিশ আনোয়ার এখন নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসির ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছে।
জানা যায়, পুরো জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একচ্ছত্র অধিপতি তিনি। এমনকি ডিবির অনেক পুলিশ পরিদর্শকরাও তার ভয়ে এতটাই টতস্থ থাকেন যে, আনোয়ার নামে কোন সোর্স ডিবিতে কাজ করেন কিনা এ ব্যাপারে তারা মুখ খুলতেও রাজি না। অথচ ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এস আই হাবিব, ফরিদ, এসপির পি এস পরিচয়ধারী এ এস আই মাহবুব এর সহযোগীতায় মাসোয়ারার সতের লাখ টাকা আদায় করে যাচ্ছেন মাসের পর মাস। তার সহযোগী হিসেবে রূপগঞ্জের দায়িত্বে থাকা তার শ্যালক সোর্স কামরুল ও ইয়াসিন প্রতি মাসে মাসোয়ার চাঁদা আদায় করছে চার লাখ টাকা। নারায়ণগঞ্জ ও বন্দর থেকে হাসান আদায় করছে পাঁচ লাখ টাকা। সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আনোয়ার, মিশুক ও জাহাঙ্গীর আদায় করছে চার লাখ টাকা , সদর ও ফতুল্লায় থেকে বিশু ও বাদল আদায় করছে দুই লাখ টাকা। সোনারগাও থেকে আনোয়ার ও হাবিব আদায় করে দুই লাখ টাকা। এভাবে আনোয়ার চক্র তেল, পলিথিন, মাদক, জুয়া, ভাঙ্গারী, কেমিক্যাল, মিল- কারখানার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের অভিযান ও মামলার ভয় দেখিয়ে ডিবি পুলিশের নামে প্রতিমাসে মাসোয়ারা বানিজ্য করে যাচ্ছে। চক্রটি মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা।
অভিযোগ রয়েছে, সোর্স আনোয়ার চক্র নারায়ণগঞ্জে চষে ভেড়াচ্ছে ভূয়া র্যাব ও ডিবি বা এসপির লোক পরিচয় হ্যানকাপ নিয়ে অফিসার সেজে। ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ সদর, সিদ্দিরগঞ্জ, রুপগঞ্জ, বন্দর, আড়াই হাজার, সোনারগাঁও থানাসহ ৭ টি থানা এলাকার বৈধ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকার মাসোয়ারা চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছে সে। কেউ চাঁদার টাকা দিতে অস্বীকার করলেই ডিবির অসাধু দারোগাদের নিয়ে অভিযান চালায়। অথচ রুপগঞ্জ ও বন্দরে তার ৩টি চোরাই তেলের দোকান রয়েছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায় পুলিশ সোর্স আনোয়ার, তার শ্যালক কামরুল সহ ৭/৮ জনের একটি সিন্ডেকেট রুপগঞ্জ হাইওয়ের পাশে অবস্থিত ভেজিটেবল অয়েল মিলস, তীর মার্কা অয়েল মিলস। এ সকল মিলগুলি রুপগঞ্জ থানা এলাকায় রুপসি হাইওয়ে রোডের পাশে থাকায় মিল থেকে ট্রাকে ড্রামজাত করে বের হলেই মটর সাইকেল নিয়ে হাজির হন ভূয়া অফিসার সেজে। আনোয়ার চক্র গাড়ীর কাগজপত্র দেখার ভ্যান করে ড্রাইভার থেকে হাতিয়ে নেয় হাজার হাজার টাকা।
জানা গেছে,সোর্স আনসারুল হক @ আনোয়ার, পিতা- সামশের আলী, মাতা-বেদনা বেগম, গ্রাম- বেড়পাড়া, থানা- দামকুড়া, রাজশাহী। তার চোরাই তেলের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন রূপগঞ্জ থানা এলাকায়। তার মূল পেশা ভুয়া ডিবি সেজে ছিনতাই ও ডাকাতি করা এবং অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য সোর্স এর কাজ করা। গত বছরের ৩ জুন ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করতে গিয়ে আসল ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন আনোয়ার (৪২) ও ভুলতা ফাড়ির রাইটার গণি (৪০)। এসময় তেলভর্তি একটি গাড়ি উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ ব্যাপারে জেলা ডিবির তৎকালীন এসআই মফিজুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা (রূপগঞ্জ থানার মামলা নং ০৮) দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, আনোয়ার সহ একটি চক্র নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে সোনারগাঁও, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন সময়ে তেলবাহী গাড়ী ছিনতাই করে থাকে। গ্রেফতারের পর আনোয়ারের স্বীকারোক্তি অনুয়ায়ী তার গোডাউন থেকে প্রায় ৫ লাখ টাকার চোরাই তেল উদ্ধার করে পুলিশ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে আনোয়ার ফতুল্লা থানায় সোর্স এর কাজ শুরু করে। কিন্তু চোরাই তেল কারবারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতার কারণে তাকে ফতুল্লা থানা থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর সে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সোর্স এর কাজ করে কৌশলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এসপি হারুনের সময়। এসপি হারুনের বদলী হলেও রয়ে যায় সোর্স আনোয়ার । এরপর তার সার্বক্ষনিক সঙ্গী হন ডিবি ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় যোগ দেওয়া অসাধু কর্মকর্তারা।
অভিযুক্ত আনোয়ারের দাবী তিনি ডিবি ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ক্যাশিয়ার ।
এ বিষয়ে ডিবির ওসি আল মামুন জানান, ডিবি পুলিশের ক্যাশিয়ার বা কোনো সোর্স নেই। তবে অভিযুক্ত আনোয়ারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পেয়েছি, তাকে আটকের চেষ্টা চলছে।
এছাড়া পুলিশের সোর্স আনোয়ারের বিরুদ্ধে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় রয়েছে ১২টি মামলা। মামলা নং ২৪(২)২১, ৩(৪)২১, ২(৩)২১, ৩(৩)২১, ৩৪(৩)২১, ৩৬(৪)২১, ১২(৪)২১, ১(৪)২১, ৩৫(৩)২১। তবে পুলিশ সোর্স আনোয়ার এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার (এডমিন) জায়েদ পারবেজ চৌধুরী বলেন, আনসারুল হক আনোয়ার চোরাই তেল বেচা কেনা ও ডিবি পুলিশের কর্মকর্তাদের নামে চাঁদাবাজি করত। এছাড়াও ডিবি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করত। এ কারনে তাকে একাধিক বার আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে। পুলিশের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকায় তাকে আটকের চেষ্টা চলছে।