
ফররুখ খসরু: নারায়ণগঞ্জের সর্বশেষ সিটি নির্বাচন নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে
অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতীক হিসেবে প্রায় সব মহলে প্রশংসিত হয়। নবনির্বাচিত মেয়র, সেলিনা হায়াৎ আইভী, যদিও ভোট গ্রহণে বিলম্বের জন্য ইভিএমকে মৃদুভাবে অভিযুক্ত করেছেন, তার প্রতিদ্ব›দ্বী সাবেক বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকার যিনি এই সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য তার দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ইভিএমকে তিনি ভোট ডাকাতির মেশিন বলে অভিহিত করেছেন। এড. তৈমুরের মতে, নারায়ণগঞ্জ গঞ্জ সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমেই ভোট কারচুপি হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে নারায়ণগঞ্জ গঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন (এনসিসি) ২০২২ ছিলো একটি যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী প্রক্রিয়া, ভোট দেওয়ার পদ্ধতিতে যেখানে ইভিএম ব্যবহার বিশেষ একটি সন্দেহজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
আসুন, এনসিসি পোল থেকে ক্ষমতাসীন দল তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে সব পরিকল্পনা নিয়েছিলো তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করি। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সরকারের ৩টি বিশেষ লক্ষ্য ছিলো, যেমন (ক) জনসাধারণের চোখে বা সাধারণের সন্তুষ্টির জন্য ইভিএমকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা, (খ) সুষ্ঠু, অবাধ এবং সহিংসতামুক্ত এবং জনপ্রশাসন এতে সম্পৃক্ত নয় প্রমাণ করা, এবং আরো প্রমাণ করা যে, (গ) নুরুল হুদা অ্যান্ড কোম্পানি ছিল নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষ, সক্ষম এবং নিরপেক্ষ। এনসিসি পোল এটিকে (নুরুল হুদা কমিশন) একটি সুযোগ করে দিয়েছিলো যেন প্রস্থানের সময় এটি তার কলংকিত অধ্যায়কে কিছুটা হলেও আড়াল করতে পারে, এবং এ কমিশনের মাধ্যমেই ইভিএমকে গুরুত্বপূর্ণ, উপযুক্ত বা কার্যকর প্রমান করা যায়। এটি মূলতঃ ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রূপরেখা প্রণয়ণে কৌশল মাত্র।
'বিলম্ব' বা 'ডাকাতি' বা 'কারচুপি' যাই বলিনা কেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারকে কারচুপির একমাত্র হাতিয়ার বলে চিহ্নিত করা যুক্তিসংগত নয়। মূলত, এটি একটি কারচুপির নির্বাচন ছিল যেখানে ইভিএমকে ফোকাস করা হয়েছিল অন্যান্য কারচুপির প্রক্রিয়াগুলিকে আড়াল করার জন্য, যা প্রকৃতপক্ষে ইভিএমের চেয়েও বিপজ্জনক। ইভিএমে ভোটদান একটি ধীর প্রক্রিয়া, শুধুমাত্র এটিকেই ইভিএম বিরোধিতার কারণ হিসেবে দাড় করানো যায় না। বাস্তবে কিছু প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে জনগণের রায় হরণ করার জন্য ভোট গ্রহণকে ধীর করা হয়েছে। খন্দকার তৈমুর, যিনি ইভিএমকে ভোট ডাকাতির একটি হাতিয়ার হিসাবে অভিহিত করেছিলেন, তাকেও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেই প্রক্রিয়ার একটি অংশ করা হয়েছিল যা তাকে কেবল ইভিএমের দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করেছিল । এতে করে কারচুপির অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলি মনোযোগের বাইরে চলে গেছে। এভাবে ইভিএম ব্যবহার সরকারের নির্বাচন কৌশলের অংশ হিসেবে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে ছিনতাই করে ভোট-পরবর্তী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে রাখা হয়েছিল। এটা মানতে হবে যে ইভিএম একটি অফলাইন প্রক্রিয়া, তাই দূরবর্তী অবস্থান থেকে মেশিনগুলি হ্যাকিং করে নিয়ন্ত্রণ নেয়া বাহ্যত অসম্ভব।
নুরুল হুদা নির্বাচন কমিশনের বিদায়েরকালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন একটি বড় পরিসরে নির্বাচন এজেন্ডা ছিল। তাই তারা এটিকে আপাতদৃষ্টিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, সহিংসতামুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এটি আরও স্পষ্ট ছিল যে একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে সরকারকে ইভিএমের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে হবে যা ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে পুরো মাত্রায় ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কারণেই সরকার নুরুল হুদা’ কমিশনকে ব্যবহার করেছিল। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতা মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইভিএম একটি অপরিহার্য ভোটদানের হাতিয়ার প্রমাণ করার সর্বোত্তম ও সহজ পন্থা ছিলো নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন -- লক্ষ্য ছিল ইভিএমের বর্তমান ব্যবহারকে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।
২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ‘জয়’ দরকার এবং ইভিএমের মাধ্যমে কীভাবে তা সম্ভব তা নিয়ে মহড়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে। এটি একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও দুটি প্রধান কারণ এ নির্বাচনে সরকারকে কারচুপির পথে পরিচালিত করে। এগুলো ছিল --- নির্বাচনকে বাহ্যিকভাবে ‘সহিংসতামুক্ত’ করে ‘নৌকার’ বিজয় নিশ্চিত করা এবং ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যক্তিকে কাউন্সিলর নির্বাচিত করার মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ ইউনিট আওয়ামী লীগের আন্তদলীয় সংঘাত প্রশমিত করা। এই কাউন্সিলরদের আয়ের কোনো আইনগত উৎস নেই, কিন্তু তারা চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছে। নৌকার জয় নিশ্চিত করতে সকল খরচ বহন করেছেন তারা। কালো টাকা এবং পেশিশক্তি নীরবে পুরো নির্বাচনী পক্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করে দরিদ্র ভাসমান নাগরিকদের ভোট কিনে নেয় এবং অন্যদিকে শিক্ষিত সাধারণ জনগণের মধ্যে ভোটদান থেকে বিরত থাকার জন্য মানসিক ভীতি তৈরি করে।
অতএব, এনসিসি নির্বাচন ২০২২-এ সরকারের প্রধান উদ্বেগ ছিল - নির্বাচনে ন্যূনতম সহিংসতার সাথে যে কোনও মূল্যে 'নৌকা'কে বিজয়ী করা এবং কিছু নির্বাচিত কাউন্সিলরদের নিশ্চিত-জয়ের সাথে দলীয় কোন্দল প্রশমিত করা। ক্ষমতাসীনরা এটা সফলভাবেই করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে,নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে সরকার কীভাবে তাদের ‘উদ্বেগ’ প্রশমিত করতে পেরেছে। বিজয় নিশ্চিত করার জন্য কোন কৌশলগুলো অবলম্বন করা হয়েছিল বা ২০২২ সালের এনসিসি নির্বাচনে সরকার দ্বারা প্রয়োগ করা নির্বাচন কৌশলের প্রক্রিয়াগুলি কী ছিল?
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কথা বলা ভালো। গত ০৫ ফেব্রæয়ারি জনাব চুন্নু বলেন, "নির্বাচন কমিশনে ফেরেশতা থাকলেও ভালো নির্বাচন সম্ভব নয় (মানবজমিন, ০৬ ফেব্রæয়ারি সংস্করণ)"। তিনি বলেন, 'কারণ বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ ও নির্বাচনের সময় পুলিশকে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালন করার কথা, কিন্তু তারা নির্বাচন কমিশনের কথা শোনে না, তারা একনিষ্ঠভাবে সরকারের কথা শোনে।'
হ্যাঁ, এটাই সত্য যে নির্বাচন কর্মকর্তাগণ, নির্বাহী বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী দপ্তরগুলি এনসিসি নির্বাচনে কারসাজি করতে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং ক্ষমতাসীন দলের কিছু কেন্দ্রীয় নেতাসহ সংশ্লিষ্ট আরো আইটি-বিষয়ক নেতা ও কিছু ইভিএম বিশেষজ্ঞও এ পক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কারিগরি ত্রæটি সারাতে ইভিএম (তথ্যপ্রযুক্তি) বিশেষজ্ঞের ছদ্মবেশে ভোট কেন্দ্রে এদের অনেককেই দেখা গেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তারা সকাল ৯টা থেকে ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে ছিলেন। প্রয়োজনীয় মেরামতের জন্য ইভিএম মেশিন অপারেট করতে ভোট কর্মকর্তাদের (সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং প্রিজাইডিং অফিসার) মত তাদেরও নির্ধারিত মেশিন কার্ড ছিল।
মেয়র আইভি যথার্থই বলেছেন, ভোট দেওয়া সত্যিই 'খুব ধীর' ছিল। এমনকি বিকাল ৩ টায়, অন্যান্য স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের দ্বারা নিরীক্ষণের হিসাবে ভোট গ্রহণের হার ছিল শুধুমাত্র (+/-) ২৫ শতাংশ। কিন্তু দিন শেষে ভোটের ফলাফল দেখায় যে ভোট হার ছিলো ৫০ শতাংশেরও বেশী। তাহলে সেই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো কি করে সম্ভব হয়েছিল? এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত ধাঁধা যা অস্তত একটি গণতান্ত্রিক নগর সরকারের স্বার্থে সমাধান করা দপ্রয়োজন। সর্বোপরি, আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে কার্যকর করার জন্য এই ধাঁধাটির সমাধান অবশ্যই করা প্রয়োজন।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের নির্বাচনী কর্মকর্তারা অর্থাৎ পোলিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বা প্রিসাইডিং অফিসাররা ইভিএম পরিচালনায় যথেষ্ট অভিজ্ঞ নন। তাঁরা আইটি বিশেষজ্ঞও নন। প্রধানত স্বল্প ইভিএম অভিজ্ঞতা আছে এমন শিক্ষক এবং ব্যাংকারদের মধ্য থেকে এ কর্মকর্তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এমনকি ভোট গণনা এবং সেই অনুযায়ী ভোটের ফলাফল প্রিন্ট করার জন্য নির্বাচনী বুথে ব্যবহৃত সমস্ত ইভিএমগুলিকে একটি একক কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করতেও তারা সক্ষম হননি। এটি করতে তারা তাদের সঙ্গে বসা তথাকথিত আইটি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়েছিলেন। ছদ্মবেশী বিশেষজ্ঞরা মূলত গোয়েন্দা পরিষেবা থেকে নিযুক্ত ছিল 'ব্যক্তিগন' যারা তাদের নিজেদের কাছে রক্ষিত কার্ড দ্বারা নির্বাচনি ফলাফল প্রকাশ ও প্্িরন্ট দিয়েছিলেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ছিল বাহ্যত 'সহিংসতামুক্ত' এবং দৃশ্যত 'দূষিত নয়' এবং 'নিরপেক্ষ' একটি নির্বাচন। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা, র্যাবের কর্মকর্তারা এবং পুলিশ বাহিনী জনসাধারণের চোখে নির্বাচনকে ‘শান্তিপূর্ণ’ করতে যথেষ্ট তৎপর ছিল এবং সরকারের ইচ্ছানুযায়ী তারা তা সফলভাবে করেছে। আমাদের নির্বাচনী কর্মকর্তারাও কিছু প্রতীকের পক্ষে 'জয়' নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের উদ্বেগ অনুযায়ী একই কাজ করেছেন।
এছাড়াও, বিগত ঘঈঈ নির্বাচনটি ইভিএম দ্বারা সূ² কারচুপির মাধ্যমে কাছাকাছি সময়ে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া ইসি এবং সরকার উভয়ের জন্যই একটি 'ক্ষতি নিয়ামকের ব্যবস্থা' ছিল। এভাবে সরকারের জন্য অত্যধিক প্রয়োজনীয় একটি বিজয় শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে। ধন্যবাদ 'আইটি বিশেষজ্ঞদের' যারা নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন এবং সফলভাবে সাধারণ জনগণের চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তুকিছু সজাগ তীক্ষè দৃষ্টির অগোচরে থেকে যেতে ব্যর্থ হন।
(লেখক এনসিসি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন)।