
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ১০ লাখ টাকার
বই কেনায় দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। বিদেশি মূল বই কেনার কথা থাকলেও স্থানীয় ছাপাখানা থেকে গোপনে কেনা হয়েছে বইয়ের ফটোকপি। অথচ সেই ফটোকপি বইয়ের দাম পরিশোধ দেখানো হয়েছে মূল বইয়ের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বই কেনার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও কর্মকর্তা মিলেমিশে এই দুর্নীতি ও জালিয়াতি করেছেন। এ নিয়ে অভিযোগ উঠলেও বিল পরিশোধ এবং ক্রয় কমিটিকে ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট যাচাই কমিটি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ভারতের এস চাঁদ প্রকাশনীর ড. আর ডি মদনের লেখা ‘মডার্ন ইনোগ্রানিক কেমিস্ট্রি’ মূল বইয়ের মুদ্রিত দাম ১ হাজার ২৮০ রুপি। বাংলাদেশে একই বই বিক্রি হয় ২ হাজার টাকায়।
রাজশাহী মহানগরীর সোনাদীঘি মোড়ের সবুজ লাইব্রেরির মালিক আবু মুসা বলেন, বইটির ফটোকপি তারা বিক্রি করেন ১৫০ টাকায়। কিন্তু রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) বইটির ফটোকপিই কিনেছে ৫ হাজার ১৮০ টাকায়। এই বইয়ের দুটি কপি কেনা হয়েছে ১০ হাজার ৩৬০ টাকায়।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ১৬ জুন রুয়েটের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান মাহবুবুল আলম জরুরি ভিত্তিতে প্রায় ৩ লাখ টাকার বই কেনার জন্য উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন।
আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, স্ট্যান্ডার্ড রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন-এসআরএফকিউ’র মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে মূল বই কেনা হবে। ওই দিনই আবেদনটি গ্রহণ করে বই কেনার অনুমোদন দেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল আলম শেখ। পরে রংপুরের কমটেক কম্পিউটার অ্যান্ড প্রিন্টার্স-২ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ইটিই, আইপিই, জিসিই, ইউআরপি এবং এমটিই বিভাগের বই সরবরাহের অর্ডার দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করেছে মূল বই নয়, ফটোকপি।
জানা গেছে, কমটেক কম্পিউটার অ্যান্ড প্রিন্টার্স-২ নামে প্রতিষ্ঠানটি কোনো লাইব্রেরিও নয়। ছাপাখানার ব্যবসা তাদের। রংপুর সিটি করপোরেশন থেকে নেওয়া ট্রেড লাইসেন্সেও দেখা যায়, ব্যবসার বিবরণে ‘ছাপাখানা’ লেখা রয়েছে। রুয়েটের ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান মাহবুবুল আলম কয়েকজন অধ্যাপক ও প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তার যোগসাজশে মূল বই বাদ দিয়ে ফটোকপি কিনেছেন। অথচ মূল বইয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি দাম পরিশোধ দেখানো হয়েছে।
একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব খাত থেকে প্রায় ২ লাখ টাকার বই কেনার অনুমোদন দেন উপাচার্য। পরে ২৭ জুন রংপুরের হাইটেক ডিজিটাল সাইন নামে আরেকটি ছাপাখানাকে বই সরবরাহের অর্ডার দেওয়া হয়। তারা এমএসই, ম্যাথমেটিকস, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও ইকোনমিকস বিভাগের বই সরবরাহ করেছেন। এখান থেকেও ফটোকপি বই কেনা হয়েছে। দাম পরিশোধ করা হয়েছে মূল বইয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। এভাবে ওই দুটি ছাপাখানার কাছ থেকে চারটি লটে মোট ৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭৭ টাকা বই নেওয়া হয়েছে।
রুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ফারুক হোসেনের বাড়ি রংপুর অঞ্চলে। আর ছাপাখানা দু’টিও রংপুরের। এই কেনাকাটার মূল ভূমিকায় অধ্যাপক ফারুক হোসেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে দাবি করা হয়েছে।
তবে রুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ফারুক হোসেন দাবি করেন, বইগুলো কেনার সময়ই নানা অভিযোগ ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। আমি প্রতিবাদ করে বলেছিলাম ফটোকপি বই লাইব্রেরির জন্য কেনা যাবে না। মূল বই-ই কিনতে হবে। কিন্তু ওপেন টেন্ডার না করে এসআরএফকিউ’ মাধ্যমে চারটি লটে বই কেনা হয়। তারা আমাকে না জানিয়েই গোপনে ফটোকপি বই কিনে লাইব্রেরিতে ভরেছে। বইগুলো হাতে নিলেই বোঝা যায় ফটোকপি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি কোনোভাবেই মানা যায় না।’ কারা তাকে না জানিয়ে ফটোকপি বই কিনে লাইব্রেরি ভরেছে, তাদের নাম-পরিচয় অবশ্য পরিস্কার করেননি অধ্যাপক ফারুক হোসেন।
এদিকে, নথিপত্রে দেখা যায়, বই কেনার পর গুণগতমান যাচাইয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ভান্ডার থেকে উপাচার্যের কাছে নোটশিট দেওয়া হয়। পরদিনই অধ্যাপক আবু সুফিয়ান মো. জিয়া হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের যাচাই কমিটি গঠন করেন উপাচার্য। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, অধ্যাপক আলী হোসেন ও প্রকৌশলী নোমান পারভেজ।
বই কেনায় দুর্নীতি ও ফটোকপি বই কেনার অভিযোগের বিষয়ে জানতে যাচাই কমিটির প্রধান অধ্যাপক আবু সুফিয়ান মো. জিয়া হাসান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। বই কেনাকাটা ও গুণগতমান যাচাইয়ে কোনো অনিয়ম পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দেননি কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক আলী হোসেন।
সম্প্রতি রুয়েটের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন ভবনে একটি কক্ষের র্যাকে রাখা হয়েছে বেশকিছু বই। কক্ষটি সংস্কারের কাজ চলছে। সেখানে বেশ কয়েকটি বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফটোকপির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বইয়ের গ্রাফ ও ছবিগুলো অস্পষ্ট। লেখাও অস্পষ্ট। এ সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান মাহবুবুল আলমও উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূল বইয়ের নামে বেশকিছু ফটোকপি বই আমাদের সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটি। পরে সেগুলো থেকে বেছে বেছে কিছু পরিবর্তনও করা হয়েছে। তবে এখনো কিছু ফটোকপি বই থেকে যেতে পারে।
বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কমটেক কম্পিউটার অ্যান্ড প্রিন্টার্স-২ এর মালিক একেএম খুরশীদ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের ছাপাখানার ব্যবসা। লাইব্রেরি নেই। বই সরবরাহের জন্য আলাদা কোনো লাইসেন্সও নেই। তবে আমরা অন্য পার্টির কাছ থেকে কিনে নিয়ে রুয়েটে বই সরবরাহ করেছি।
তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, বই কেনায় কোনো দুর্নীতি বা জলিয়াতি হয়েছে কি না আমার নেই।
এ বিষয়ে টিআইবি পরিচালিত সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) রাজশাহীর সভাপতি অধ্যাপক ড. দীপকেন্দ্র নাথ দাস বলেন, শিক্ষকরাও যদি পয়সার কাছে নিজেদের বিবেক ও আত্মমর্যাদা বিক্রি করেন, তাহলে জাতি আর কোথায় যাবে! এটি জাতির জন্যই লজ্জার। রুয়েটে বই কেনায় দুর্নীতির বিষয়টি দুদককে অবহিত করা হবে।