
এশিয়া খবর ডেস্ক:: দেশের সড়কগুলোতে চলাচলকারী যান্ত্রিক যানবাহনগুলোর নিবন্ধন এবং এর
চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। রাজধানী ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়েও রয়েছে সরকারি এ সংস্থাটির আঞ্চলিক কার্যালয়।
একইভাবে জয়পুরহাটেও সংস্থাটির আঞ্চলিক কার্যালয় থাকলেও সেখানে সেবাপ্রার্থীদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে। নতুন সড়ক আইন কার্যকরের পর থেকে সেখানে যেমন সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি যেন সুসময় এসেছে দালালদেরও। সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ায় দালালদের এখন পোয়াবারো অবস্থা।
তবে পরিস্থিতি শুধু এখানেই থেমে নেই, জয়পুরহাট শহরের বেশ কয়েকটি জায়গায় ব্যক্তিগত বিআরটিএ অফিস গড়ে তুলেছে শক্তিশালী দালাল চক্র! যেখানে মেলে বিআরটিএ’র সব ধরনের সেবা। অভিযোগ রয়েছে, জয়পুরহাট বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের যোগসাজশেই চলছে তাদের এসব কার্যক্রম। এমনকি বিআরটিএ’র কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে নিয়মিত অফিস করেন বলেও এলাকাবাসীর ভাষ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর ১ নভেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের ঘোষণা আসার পর থেকেই যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন এবং চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য জয়পুরহাট বিআরটিএ কার্যালয়মুখী হচ্ছেন যানবাহন মালিক ও চালকরা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বিআরটিএ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসদাচরণ ও নানা হয়রানির কারণে চালকরা খুঁজে নিচ্ছেন স্থানীয় কোনো দালাল অথবা শহরে গড়ে ওঠা দালাল চক্রের ‘ব্যক্তিগত বিআরটিএ কার্যালয়’।
সরকারিভাবে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ২১৯৭ টাকা এবং অপেশাদারের জন্য ২৮৮৭ টাকা নেওয়ার নিয়ম থাকলেও দালাল চক্র এজন্য হাতিয়ে নিচ্ছে সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত।
অন্যদিকে সিএনজি রেজিস্ট্রেশনে ১১ হাজার ৪৫০ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকার বেশি। এর বাইরে অন্যান্য সেবা নিতে গেলেও গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। আর এভাবে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালাল চক্র সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে বছরে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
জানা যায়, জয়পুরহাট বিআরটিএ কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় শহরের জিরো পয়েন্টে পৌর মার্কেটের পেছনের গলিতে কাজী মোসলেম এবং সদর রোড সিও কলোনিতে বিপ্লব হোসেনসহ আরও কয়েকজন বাসা ও দোকান ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘বেসরকারি বিআরটিএ অফিস’। যেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে বিআরটিএ’র সব ধরনের সেবা। তারা এ ‘বেসরকারি বিআরটিএ অফিস’ পরিচালনায় কয়েকজন সহকারীও রেখেছে।
বিআরটিএ’র সেবা নিতে আসা পাঁচবিবির মিননুর রহমান বলেন, ‘দালালকে ঘুষ দিয়ে লাইসেন্সের কাগজ প্রসেস করতে হয়েছে। আমরা বিআরটিএ অফিসের গিয়ে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে ওদের আচরণ দেখলে মনে হয় যে ওরাই মালিকপক্ষ। তারা আমাদের মানুষই মনে করে না। তারা চায়, আমরা দালালদের মাধ্যমে এখানে আসি। দালালদের কাছে টাকা দিলে আমাদের আর কোনো চিন্তা থাকে না। বারবার হয়রানি বা ভোগান্তিতেও পড়তে হয় না।’
শহরের জিরো পয়েন্টে পৌর মার্কেটের পেছনের গলিতে গড়ে ওঠা কাজী মোসলেমের ‘বেসরকারি বিআরটিএ অফিস’ লাগোয়া একটি দোকানের মালিক মেজবাউল ইসলাম শুভ বলেন, ‘বিআরটিএ অফিসের কার্যক্রম পৌর মার্কেটের পেছনের এই গলিতে হয়। বিআরটিএর যে কর্মকর্তারা আছে, উনারা এখানে বসে অফিস করে। এখানে উনাদের কনটিনিউ যাতায়াত হয়। সব নাগরিক বিআরটিএ অফিসের সেবা পাবে। কিন্তু বিআরটিএ সেবা দেখি দালালের মাধ্যমে উনারা এই গলির অফিসেই দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
পরিচয় গোপন রেখে সিএনজির রেজিস্ট্রেশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার জন্য এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় ‘বেসরকারি বিআরটিএ অফিস’ গড়ে তোলা বিপ্লব হোসেনের। তার সঙ্গে ওই কাজ দুটির জন্য যথাক্রমে ২০ হাজার ও সাড়ে ৯ হাজার টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। কিন্তু পরে সাংবাদিক পরিচয়ে সামনাসামনি কথা হলে বিপ্লব বলেন, ‘আমরা এগুলো (অতিরিক্ত টাকা) নেই নাকি! বিআরটিএ অফিসাররাই নেয়।’
‘বেসরকারি বিআরটিএ অফিস’ গড়ে তোলা কাজী মোসলেমের কার্যালয়ে গিয়ে টেবিলে পড়ে থাকতে দেখা যায় বিআরটিএ’র বিভিন্ন সেবার শত শত ফরম ও বিভিন্ন কাগজপত্র। এভাবে ব্যক্তিগত কার্যালয় খুলে বিআরটিএ’র সেবাদানের বৈধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজী মোসলেম বলেন, ‘এখানে বসে আমি শুধু ফরম পূরণ করে দিই।’ এ কথা বলেই সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়েন তিনি।
দালাল চক্রের সদস্যরা একেকজন কীভাবে এক দিনে ৫০ থেকে ১০০ জনের ফরম জমা দিচ্ছে তা জানতে চাইলে বিআরটিএ’র জয়পুরহাট কার্যালয়ের পরিদর্শক এসএম ফরিদুর রহিম বলেন, ‘যেটা হয়ে গেছে সেগুলোর ব্যাপারে এডি (সহকারী পরিচালক) স্যার জানেন। আমি কিছু বলতে পারব না।’
অন্যদিকে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে বিআরটিএ’র জয়পুরহাট সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি) আবদুল হান্নান বলেন, ‘তাদের (দালাল চক্র) ধরিয়ে দিন। গত দুই মাস মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে না পারায় আমাকে ডিডি অফিসে কথা শুনতে হয়েছে। যে-ই জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করবে, তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।’
জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিআরটিএতে দালালদের ব্যাপারে সংবাদ পেলেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’